টাইফয়েড জ্বর কি ?
টাইফয়েড জ্বর (Typhoid fever) একটি সংক্রামক রোগ যা সালমোনেলা টাইফি (Salmonella Typhi) নামক এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনে হয় । সাধারণত দূষিত খাবার বা পানির মাধ্যমে এই রোগের জীবাণু ছড়ায় । আবার আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলেও এ রোগ হতে পারে । সাধারনত সংক্রমনের ১ থেকে ৩ সপ্তাহ পরে এই রোগের লক্ষন প্রকাশ পায় । এই রোগের প্রধান লক্ষন সমূহের মধ্যে আছে জ্বর, মাথাব্যথা, বুকের উপর গোলাপি দাগ, লিভার বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, ডাইরিয়া কিংবা কোষ্ঠ্যকাঠিন্য ইত্যাদি ।
টাইফয়েড জ্বরের কারণ কি ?
টাইফয়েড একটি পানি বাহিত মারাত্মক রোগ যা দুই ধরনের জীবাণুর সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে । (১)‘সালমোনেলা টাইফি’এবং (২) ‘সালমোনেলাপ্যারা টাইফি’।
সালমোনেলা টাইফির সংক্রমণে যে জ্বর হয় তাকে টাইফয়েড জ্বর বা ‘এন্টারিকফিভার’বলে । আর যদি জ্বর সালমোনেলা প্যারাটাইফির নামক জীবাণুর কারণে হয় তখন তাকে প্যারাটাইফয়েড জ্বর বলে ।
প্রধানত দূষিত পানি ও খাবার গ্রহণের মাধ্যমেই এই জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে । পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদাসীনতার কারণেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে । এছাড়াও টাইফয়েড জ্বর হতে আরোগ্য লাভ করেছেন কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া বহন করছেন এমন কিছু সংখ্যক ব্যক্তিও এই রোগের বাহক হতে পারে । এই জীবাণু শরীরে যেভাবেই প্রবেশ করুক না কেনো ঢুকার পর তা বৃহদান্ত্রকে আক্রমণ করে । এছাড়া এই ব্যাকটেরিয়া শরীরের পিত্ত থলিতে জমা থাকে এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই কেবল আক্রমণ করে ।
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ কি ?
টাইফয়েড রোগের জীবাণু দেহে প্রবেশের সাধারণত ১০ থেকে ১৪ দিন পর এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে । প্রথম সপ্তাহে টাইফয়েড রোগের প্রধান উপসর্গ হল জ্বর এবং জ্বর কখনো বাড়ে, কখনো কমে; তবে কোনো সময় সম্পূর্ণ ছেড়ে যায় না, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা, জিহ্বার উপরিভাগে ময়লা জমা ইত্যাদি । শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হয় । দ্বিতীয় সপ্তাহে জ্বরের সঙ্গে পাতলা পায়খানা শুরু হয় । এ সময় প্লীহা বড় হয়ে যেতে পারে । কারো কারো জ্বরের সঙ্গে কফ বা কাশি হতে পারে । হার্ট রেট বা হৃদ স্পন্দন কমে যেতে পারে । ওষুধ চলা অবস্থায়ও সপ্তাহ খানেক জ্বর থাকতে পারে । যদি ঠিক মতো চিকিৎসা না হয় তবে তৃতীয় অথবা চতুর্থ সপ্তাহে পরিপাক নালীতে নানা রকমের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে ৷ জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষুদ্রান্ত্র ফুটো হয়ে যেতে পারে অথবা পরিপাক নালী থেকে রক্তপাত হতে পারে ।
টাইফয়েড রোগের প্রতিকার কি ?
টাইফয়েড জ্বর প্রতিরোধে তিন ধরনের টিকা আছে । একটি মুখে খাওয়ার এবং বাকি দুটি ইনজেকশন । তবে টিকা ব্যবহারে সফলতার হার ৫০ থেকে ৮০ ভাগ । দু বছরের বেশি বয়সী শিশুরা এ টিকা নিতে পারবে। টিকা কার্যকর থাকে তিন বছর ।
ভ্যাক্সিনের পাশাপাশি নিম্ন লিখিত পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করা দরকার :
- শাক সবজি, ফলমূল এবং রান্নার বাসন পত্র সবসময় পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে ।
- খাবার ভালভাবে রান্না বা সিদ্ধ করে তারপর খাওয়া উচিত ।
- খাবার গ্রহণ, প্রস্তুত বা পরিবেশনের পূর্বে খুব ভালভাবে হাত ধৌত করতে হবে ।
- পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুটানো পানি বা পরিশোধিত পানি সংরক্ষণ করতে হবে এবং পানি যাতে দূষিত হতে না পারে সেজন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণ কৃত সেই পানি পান করা উচিত ।
- বোতল জাত, পরিশোধিত বা ফুটানো পানি হতে বরফ তৈরি করা না হলে সেই বরফ মিশিয়ে পানি বা অন্য কোন পানীয় পান করা হতে বিরত থাকতে হবে ।
- রাস্তার পার্শ্বস্থ দোকানের খাবার গ্রহণ এবং পানি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত ।
- টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে ।
- টয়লেট ব্যবহারের পর, শিশুকে পরিষ্কার করার পূর্বে, খাবার প্রস্তুত বা পরিবেশন করার পূর্বে, নিজে খাওয়ার পূর্বে বা শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে ।
টাইফয়েড জ্বরের জন্য কি পরীক্ষা বা ল্যাবরেটরী টেস্ট করতে হয় ?
প্রথম সপ্তাহে টাইফয়েড জ্বর নির্ণয় করা কঠিন । সেক্ষেত্রে রোগের ইতিহাস কিছুটা সাহায্য করে । যেমন ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকা, তাপমাত্রার তুলনায় নারীর গতি কম । এ সময় ল্যাবরেটরী পরীক্ষার মধ্যে রক্তের কালচার অর্থাৎ Blood C/S পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ ।
দ্বিতীয় সপ্তাহে ভিডাল অর্থাৎWidal টেস্ট করতে হবে ।
এছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে প্রস্রাব কালচার (Urine C/S) ও পায়খানার কালচার (Stool C/S) পরীক্ষা করতে হবে।
টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা কি ?
জ্বর ও ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট দিনে ৪- ৫ বার সেবন করা যাবে (চিকিৎসকের
পরামর্শ অনুযায়ী) । এ জ্বরের মূল চিকিৎসা করা হয় এন্টিবায়োটিক ঔষধ এর মাধ্যমে । যে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই শুরু করা হোক না কেন, চিকিৎসা ১০থেকে ১৪ দিন পর্যন্ততা অব্যাহত রাখতে হয় ।
টাইফয়েড জ্বরের জন্য এন্টিবায়োটিক ঔষধ গুলো কি কি ?
টাইফয়েড জ্বরের জন্য এন্টিবায়োটিক ঔষধ গুলো হলো :
ক্লোরামফেনিকল, কোট্রাইমোক্সাজল, এমোক্সিসিলিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ওফ্লক্সাসিন, ফিফ্লক্সাসিন, সেফিক্সিম , সেফ্ট্রিক্সন ।
যেকোনো
একটি এন্টিবায়োটিক অবশ্যই
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে
। এখানে বলে রাখা ভালো ‘ক্লোরামফেনিকল’ এর
খারাপ ও মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকার কারণে এই এন্টিবায়োটিক বর্তমানে
ব্যবহৃত হচ্ছে না
।
No comments:
Post a Comment